সিরাতুল মুস্তাকিমের সন্ধানে
সিরাজুম মুনীরা
আজ আমি আমার নিজের জীবন সম্পর্কে বলবো। আমার জীবনটা আমার কাছে সবসময় শিক্ষণীয় মনে হয়। আমি মনে করি, এ আমার মহান আল্লাহ তা‘আলার এক অনবদ্য উপহার ও দান আমার জন্য। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত এবং প্রকৃত মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” (সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত : ১০২) প্রকৃত মুসলিম হবার ও পূর্ণ ঈমানের স্বাদ পাবার চেষ্টায় আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম।
আমার জন্ম রাজশাহী শহরে। বাবা চাকুরীজীবী ও মা গৃহিণী। আমরা তিন বোন। আমি বড়। পারিবারিকভাবেই আমাকে ইসলামী শিক্ষার দিকে ধাবিত না করে এবং কোনো মাদরাসায় শিক্ষার সুব্যবস্থা না করে আমার মা-বাবা আমাকে তথাকথিত জেনারেল শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। বাবা-মায়ের খুব শখ ছিল আমাকে ডাক্তার বানাবেন। এক্ষেত্রে আমি নিজস্ব গতিতে অগ্রসর হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারীজ বিভাগের স্বর্ণপদক ঘোষিত অনার্স ও মাস্টার্সে ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করার গৌরব অর্জন করেছি।
জেনারেল শিক্ষায় আকাশছোঁয়া উন্নতি করলেও আমার এ পথ চলার শুরুতেই ছিল পর্যাপ্ত দ্বীনের আলোর অভাব। আর আলোর অভাব হলে হোঁচট খেতেই হবে। তাইতো আমার সকালটাই শুরু হতো টিভিতে গান-বাজনা দেখে। তারপর পড়ার জন্য স্কুল-কলেজে বেরিয়ে পড়তাম পর্দাবিহীন অবস্থায়। বাসায় ফিরে আবার টিভি দেখতাম এবং ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করতাম।
কিন্তু কী পড়তাম আমি আসলে? আজ আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, একটা মেয়ে হিসেবে আমার কতটুকু কী পড়তে হতো এবং কিসের মরীচিকার পিছনে আমাকে ছোটানো হয়েছিল। এত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে গিয়ে আমি মুসলমান হিসেবে অপরিহার্য আমল নামায-রোযা ঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। দ্বীনের আবশ্যকীয় ফরজ আমলগুলো পালনে আমাকে কেউ তাগাদা দেননি। হয়ত আমাকে ভালোবেসে, হয়ত ভেবেছেনÑমেয়ের কষ্ট হবে। কিন্তু এ আদর দেখাতে গিয়ে তারা যে আমাকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তির দিকে ঠেলে দিয়েছিলেনÑতা কি তারা ভেবে দেখেছেন?
ভাবলেও শিউরে উঠতে হয় যে, তখন ইসলামের নিয়মের বাইরে পর্দাহীনভাবে নারী-পুরুষের সহশিক্ষার মতো গুনাহর রাস্তায় অধিক বিচরণলব্ধ শিক্ষা আমাকে স্বর্ণপদক এনে দিলেও, এদিকে সোনার রং যত চকচকে হয়েছে, অন্যদিকে আমার জীবনের প্রকৃত রং ততই ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। আমার জীবনটা বাইরে থেকে খুব চকচকে এবং অনেকের কাছে বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে খুবই ঈর্ষণীয় ছিল। কেন নয়! আমি নিজেই তখন নাওয়া-খাওয়া ও ঘুমবিহীনভাবে সেই জগতে অহর্নিশ ছুটে বেরিয়েছি। এই জগতটাকেই সবকিছু মনে করে গ্রাজুয়েট হবার মনোভাব নিয়ে অন্যসবকে পিছনে ফেলে দুর্বার গতিতে সামনে চলেছি।
হঠাৎ আমার মনের মাঝে যেন হিদায়াতের শীতল হাওয়া বয়ে যেতে শুরু করল। পরিবার থেকে আমাকে ছোটকালে নামায, রোযা ও কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। আর এ বিন্দু বিন্দু পানিই যেন ধীরে ধীরে আমার মাঝে মহাসমুদ্রের প্রতি আকর্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিল। আমি বিভিন্ন ইসলামী বই-পুস্তক ও মাসিক আদর্শ নারী পড়ে দ্বীনের বুঝ অর্জন করতে শুরু করলাম।
তখন ধীরে ধীরে আমার মাঝে সঠিক বিষয়গুলোর বোধোদয় হতে শুরু করলো। নিজের মাঝের শূন্যতাগুলো যেন আবিষ্কার করতে লাগলাম। হায়, একি শূন্যতা! অন্তরজুড়ে শুরু হলো সঠিক কাজগুলো সারাজীবন সঠিকভাবে করতে না পারার হাহাকার। করতে থাকলাম অনুশোচনা আর অনুতাপ।
জানতে পারলাম, ইসলামী জ্ঞানার্জন করা ফরজ। আর এই ফরজ জ্ঞানের আলোর অভাবে জীবনের কতটা পথই না আমাকে অন্ধকারে অতিক্রম করতে হলো।
এ দ্বীনী বুঝ পেয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তৃতীয় বর্ষ থেকে ধীরে ধীরে পর্দা করা শুরু করে দিলাম। অল্প অল্প করে আমার মনটা পরিবর্তিত হয়ে যেন প্রকৃত ঈমানের স্বাদ খুঁজতে লাগল। যারা আল্লাহর রাস্তায় চলে না তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে যারা আল্লাহ তা‘আলার বিধান অনুযায়ী চলে তাদের সাথে মিশতে শুরু করলাম। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও যখন একজন পূর্ণ মুসলিম হিসেবে নিজের জীবন সঠিক আলোয় পরিচালিত হয়নি, সেই আত্মগ্লানি নিয়েই আমি নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করতে লাগলাম।
এমনকি তখন বাসায় মা-বাবা ও ছোট বোনদের বোঝাতে শুরু করলাম সঠিক পথ কোন্টা। কারণ, আমি চাই নাÑতারা সঠিক জ্ঞানের ও ইসলামের পথের আলো হতে বঞ্চিত হবে।
আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমি নিকাবসহ বোরকা পরায় পরিপূর্ণ অভ্যস্ত। ইসলামের বিধান মতে, মেয়েদের ঘরের অভ্যন্তরে থাকা কর্তব্য। এমনকি তাদের বাইরে চাকরী করারও প্রয়োজন নেই। কারণ, তাদের জরুরত ও জীবিকার সমূদয় ব্যবস্থা আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের মাধ্যমে করে দিয়েছেন। তাই আমি এ নিয়তেই নিজেকে ঘরে ইবাদত-বন্দেগীতে আবদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছি। অপরদিকে টিভি জাহান্নামের বাক্স হবার কারণে তাকে বাসা থেকে তাড়িয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ, এতে বিরাট উপকার হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা মতো সঠিক সময়ে আদায় না করা এবং ফরজ হকগুলোর কাজা আদায়ের সময় পাচ্ছি এবং আরো দ্বীনী জ্ঞানার্জন ও পরিপূর্ণভাবে তা পালনের সুযোগ পাচ্ছি। সেই সাথে সময় পেলেই জিকিরে আত্মনিবেশ করে জিহ্বাকে যিকিরকারী জিহ্বা ও অন্তরকে কৃতজ্ঞতাপরায়ণ অন্তর করার চেষ্টা করছি।
তথাপি আজও পিছনে ফিরে চাইলে আমার অন্তরে যে অতৃপ্তির ও বেদনার ঝড় ওঠে, মনটা দুমড়ে-মুছড়ে যায়, তার জন্য অনুতপ্ত হই, অনুশোচনা করি। মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আর তাকে কেন্দ্র করেই প্রকৃত জ্ঞান ও প্রকৃত ঈমানের স্বাদ পাবার আশায় সর্বদা ইবাদতে ব্যাপৃত থাকতে সচেষ্ট হই।
গতিময় জীবনের প্রবাহমান ধারায় সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি (মাস্টার্স) শেষ করার পর আমার পরিবার আমার বিবাহের সিদ্ধান্ত নেন। আমি জীবনের এই নতুন মোড়টাতে এসেও প্রত্যয় করেছি ঈমান রক্ষায় কোনো আলেম পরিবারে যাওয়ার জন্য। আল্লাহর মেহেরবানীতে সেই আশাও পূর্ণ হয়েছে।
পরিশেষে জীবনের অন্তিম সময়ের কথায় এসে যাই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।” (সূরাহ আম্বিয়া : ৩৫) তাই এই মৃত্যুর পূর্বেই আমাদের সকলের উচিতÑপরকালকে নিয়ে বেশী ভাবা এবং তার জন্য প্রস্তুতি নেয়া। সে জন্য আখিরাতের সামান তৈরীতে আমি এখন প্রতিনিয়ত নিয়োজিত রয়েছি।
আসুন না, সবাই নিজেকে একবার প্রশ্ন করে দেখি, আমরা কি পূর্ণ মুসলমান, নাকি নামধারী মুসলমান? আমরা পরিপূর্ণভাবে নবীজীর আদর্শ অনুসরণ করছি কি না? অপূর্ণতা ও দুঃখ ছিল বলেই হয়ত প্রকৃত ঈমানের স্বাদটা আজ আমার কাছে খুবই মধুর। এ যেন আমার দেরীতে পাওয়া কুড়ানো মানিক। এভাবে আসুন, সবাই এ জীবনের মূল্য বুঝি, হারানোর প্রতিটি মূল্যবান মুহূর্তকে কদর করি। আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক দিন (আমীন)।
Allah Amaders sobaike Hedaet dan korun
Amin
We should take instruction from this life story.ALLAH give us Toufik.Amin
Really encouraging! Allah amader shobaike shothik poth er shondhan dik.ameen!